বিষাক্ত প্লাস্টিকের দখলে আমাদের দৈনন্দিন যাপন

প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যায় না। ১০০০ বছর ধরে ভেঙে ভেঙে এর অতিক্ষুদ্র কণা মাটিতে মিশে বরং পরিবেশের দূষণ ঘটায়। অথচ আজ আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি এবং ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই প্লাস্টিকের। পানির বোতল থেকে খাবারের থালা, শিশুদের খেলনা থেকে প্রসাধনীর মোড়ক, কিছুই এর বাইরে নয়। ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড সম্পূর্ণ কৃত্রিম প্লাস্টিক আবিষ্কার করলেও ১৯৫৮ সালের পর থেকে এই প্লাস্টিক পৃথিবীব্যাপী ক্রেতা-ভোক্তার ক্রয়সীমানা এবং দৈনন্দিন জীবনযাপন দখল করে নিতে থাকে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির এক সূত্র অনুযায়ী (২০২২), ১৯৫০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৯.২ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে। ১৯৫০ সালে ২.৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় যা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৪৮ মিলিয়ন টন (সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক)। পৃথিবীর জনসংখ্যার মোট ওজনের সমান প্লাস্টিক প্রতিবছর উৎপাদিত হয় (সূত্র : আর্থডে)। বর্তমানে পৃথিবীতে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক উৎপন্ন করে এবং প্লাস্টিক দূষণ ঘটায়। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার শুরু হয়। ২০০২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রতিদিন একটি পরিবার গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করত। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে দৈনিক ৪৫ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হতো, ২০০০ সালে ৯৩ লাখ। পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কঠিন বর্জ্যরে ১০ ভাগই প্লাস্টিক। বেসরকারি পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসডোর জরিপ বলছে, দেশে বছরে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় ৮৭ হাজার টন। প্লাস্টিক পচে না, গলে না, প্রকৃতিতে মিশে যায় না। ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর লাগে প্লাস্টিকের রূপান্তর ঘটতে। প্লাস্টিক ভেঙে অতিক্ষুদ্র কণা হিসেবে বাতাস, মাটি, পানি, খাদ্যচক্র এবং প্রাণীর শরীরে মিশে যায়। প্লাস্টিকের এই পচনরোধী বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং জনস্বাস্থ্যে নানামেয়াদি ও বহুমুখী দূষণ ও সংকট তৈরি করে, প্লাস্টিকের কারণে সংগঠিত এই দূষণই হলো ‘প্লাস্টিক দূষণ’। মানুষসহ পৃথিবীর সকল প্রাণ-প্রজাতি, জল, স্থল, অন্তরিক্ষ এবং সমাজ-সংস্কৃতি আজ প্লাস্টিক-দূষণে আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত। বিগত ৫০ বছরে বিশ্বে মাথাপিছু এক টনেরও বেশি প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদিত হয়েছে। এর কিছু অংশ পোড়ালেও বেশিরভাগই প্রাণ-প্রকৃতিতে বর্জ্য হিসেবে দূষণ তৈরি করেছে। প্রতিবছর ৪৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার অর্ধেকের বেশি এশিয়ায়। এমনকি প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ হয় ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে। ম্যাক্রো বা বড় (২০ মাইক্রোমিটার/মিমির চেয়ে বড়) এবং মাইক্রো বা অতিক্ষুদ্র (২-৫ মিমি) প্লাস্টিকবর্জ্য উভয়ে নানাভাবে নানামাত্রার দূষণ ঘটায়। প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয় একটি বিশেষ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে। এ বছরের প্রতিপাদ্যকে পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলা করেছে, ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে শামিল হই সকলে।’ 

কিন্তু এই প্লাস্টিককে কি একদিনে একভাবে ‘না’ বলে ফেলা সম্ভব? এর জন্য দরকার নানামেয়াদি পরিকল্পনা, অঙ্গীকার ও বাস্তবায়ন। সব প্লাস্টিককে প্রথমেই ‘না’ বলা সহজ না হলেও, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিককে না করার ভেতর দিয়ে প্লাস্টিকবিরোধী যাত্রা হয়তো আমরা শুরু করতে পারি। তাহলে কী করতে হবে? মানসিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ এবং চর্চাগতভাবে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি থেকে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্পগুলো খুঁজে এর ব্যবহারকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এভাবেই মন, শরীর, ঘর, বাজার, মুনাফা, সংস্কৃতি, উৎপাদন- সকল জায়গা থেকেই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিককে আমরা চাইলেই উধাও করে দিতে পারি। আর প্লাস্টিক দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে আমাদের এই জনতৎপরতাই হতে পারে এক কার্যকর প্রাথমিক পদক্ষেপ। চলতি আলোচনাটি প্লাস্টিকের বহুমুখী প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং প্লাস্টিক দূষণ থেকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে কিছু করণীয় বিষয় জনপরিসরে প্লাস্টিকবিরোধী তৎপরতা গড়ে তুলতে আলোচনার সূত্রপাত করছে। 

মাটিতে প্লাস্টিকের প্রভাব
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (২০১৮) এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জার্মানির গবেষকেরা প্রমাণ করেছেন সমুদ্রের থেকেও প্রায় ২৩ গুণ বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটে মৃত্তিকা বাস্তুতন্ত্রে। ২০২০ সালে ‘দ্য রয়েল সোসাইটির প্রসেডিংসে’ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিক দূষণের ফলে মাটির কেঁচো, লার্ভা, মাইট ও খুদে জীবের বৈচিত্র্য হ্রাস পায়। প্লাস্টিকে থাকা ক্লোরিন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে মাটিকে দূষিত করে। মাটির ভেতর দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যায়। ভূ-গর্ভস্থ পানির মাধ্যমে এই বিষাক্ত পদার্থ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। চাষাবাদের ফলে মাটিতে মেশা প্লাস্টিকের বিষাক্ত উপাদান উদ্ভিদে প্রবেশ করে এবং তা খাদ্যের মাধ্যমে প্রাণী ও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে (সূত্র : ইন্টারঅ্যাকটিভ এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন বুক-৮)। 

মেরাদিয়া খাল।

মাটিতে থাকা সিউডোমোনাস, নাইলন খাদক ও ফ্লাভো ব্যাক্টেরিয়া নাইলোনেজ এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে প্লাস্টিক অণু ভেঙে দেয় এবং এর ফলে প্রচুর মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্যও দায়ী (সূত্র : সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ২০১৩)। 

২০১৮ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাসিল-রটারডাম এবং স্টকহোম কনভেনশন এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি মিলে আয়োজিত ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দূষণ সিম্পোজিয়ামে’ প্লাস্টিক দূষণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে প্লাস্টিকসহ কঠিন বর্জ্য মূলত স্তূপ করে নিম্ন-জলাভূমি এলাকা ভরাট করে ফেলা হয়। ঢাকার চারপাশে নিম্ন-আয়ের মানুষের বসতি এলাকা ও নতুনভাবে বর্জ্য ফেলে ভরাট করা জায়গাগুলোতে প্রাকৃতিক মাটি নেই। প্লাস্টিক মেশা জৈবিকভাবে মৃত এসব মাটিতে বীজের অংকুরোদগম হচ্ছে না। 

পানি ও জলাভূমির ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব
প্লাস্টিক দুইভাবে পানি সংকট তৈরি করে। পলিথিন-প্লাস্টিক সরাসরি খাল-নালা-নদী-জলাভূমির প্রবাহ আটকে ফেলে এবং জলাবদ্ধতা তৈরি করে। প্লাস্টিকের স্তূপ জলজ জীবের খাদ্য উৎস এবং বাসস্থানকে বিনষ্ট করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক পানিতে মিশে পানির গুণাগুণ এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে। নদী দূষণ ও দখলের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য। দেখা যায়, নদীর তীর ও পাড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে জায়গা ভরাট করে শেষ পর্যন্ত নদীর এলাকা নানাভাবে বেদখল করা হয়। আবার প্লাস্টিকসহ কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এবং নদীতে ফেলা প্লাস্টিক নদীর প্রাণকে হত্যা করে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী ও বালু নদীর তলদেশে বহু স্থানে শক্ত প্লাস্টিক বর্জ্যরে স্তর জমেছে। 

প্রতি মিনিটে একটি আবর্জনা ট্রাকের সমান প্লাস্টিকের বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হয়।

ওয়াটার ওয়ার্ল্ড (২০১৬) জানায়, কাপড় ধোয়ার মেশিন থেকে সাত লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, একবার সিনথেটিক জ্যাকেট ধোয়ার ফলে ১.৭ গ্রাম মাইক্রোফাইবার পানিতে মিশে যায়। 

প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মতো প্রবাহগুলোকে দূষিত করে সমুদ্রের পরিবেশকেও বিনষ্ট করে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সূত্রমতে, পদ্মা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক বঙ্গোপসাগরে মেশে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির মতে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে মেশে। প্রতিবছর ৮ থেকে ১২.৭ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হয় (সূত্র : টিআর ফান্ড)। এসডোর গবেষণায় দেখা যায়, ১৮টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মাধ্যমে প্রতিবছর ২.৬ মিলিয়ন টন একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মেশে। প্রতিবছর পৃথিবীতে যে ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়, যার ৮০ ভাগ গভীর সমুদ্রে ভাসমান বর্জ্যস্তূপ হিসেবে দেখা যায় কিংবা তলদেশে জমা হয় (সূত্র : আইইউসিএন, ২০২১)। ২০১৯ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, সমুদ্রের পানিতে ১.৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রোফাইবার মিশে আছে। প্লাস্টিক দূষণ আজ সমুদ্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনের জন্য এক বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ঢাকার পাশে একটি নদী থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছে।

কৃষি ও খাদ্যচক্রের ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব
প্লাস্টিক দূষণের কারণে উদ্ভিদের শেকড়ের বৃদ্ধি ও পুষ্টিচক্র ব্যাহত হয়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘অ্যাসেসমেন্ট অব এগ্রিকালচারাল প্লাস্টিকস অ্যান্ড দেয়ার সাসটেইনবিলিটি ২০২১’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে উদ্ভিদ ও প্রাণিজাত খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে ১২.৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় এবং পরবর্তী সময়ে খাদ্য প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয় আরও ৩৭.৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক। সবুজ বিপ্লব পরবর্তী রাসায়নিক কৃষির সার-বিষ-প্যাকেটজাত বীজের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকমাত্রায় প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। বিশেষ করে বোরো ও রবি মৌসুমে প্রতিটি কৃষি জমির চারধারে এবং ডোবা-জলার পাশে বালাইনাশক ও হাইব্রিড বীজের প্লাস্টিক প্যাকেট ও বোতলের স্তূপ দেখা যায়। এসব যারা সংগ্রহ করেন বিষয়টি তাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। 

প্লাস্টিক কণা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আজ আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়েছে। শস্য, মাংস, মাছ, সর্বত্র মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করতে হলে কৃষিকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও নিরাপদ খাদ্য আইনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। 

প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব
প্লাস্টিক দূষণের কারণে কমছে পৃথিবীর প্রাণ-প্রজাতির বৈচিত্র্য। প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে প্রায় ৩৪ ভাগ সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু ঘটে (সূত্র : সেক্রেটারিয়েট, প্যাসিফিক রিজিওনাল এনভায়রনমেনট প্রোগ্রাম ২০০৮)। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লাখ ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়; কিন্তু ব্যবহারের পর এসব প্লাস্টিক ব্যাগ পুনর্ব্যবহার না করে নিম্নাঞ্চল ভরাট ও সমুদ্রে বর্জ্য হিসেবে ফেলা হয় (সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ২০১৮)। পৃথিবীর ১০ ভাগের এক ভাগ অক্সিজেন উৎপাদনকারী সামুদ্রিক অণুজীব প্রোক্লোরকক্কাস প্লাস্টিক দূষণের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন (সূত্র : ইকোলজি সেন্টার, ২০২১)। 

বিজ্ঞানীরা ৮৬ ভাগ সামুদ্রিক কচ্ছপ, ৪৪ ভাগ সামুদ্রিক পাখি এবং ৪৩ ভাগ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে প্লাস্টিক বর্জ্য ও কণার উপস্থিতি পেয়েছেন। কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ খেয়ে বাঁচে, সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ব্যাগকে তারা ভুল করে জেলিফিশ হিসেবে খেয়ে ফেলে। এভাবে তাদের পাকস্থলী বন্ধ হয়ে যায় এবং একসময় এরা মারা যায় এবং বংশবিস্তারও রুদ্ধ হয়। বহু সামুদ্রিক পাখি সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক টুকরাকে মাছ ভেবে ভুল করে খেয়ে ধীরে ধীরে মারা যায়। এরকম বহু মৃত প্রাণীর প্লাস্টিকভর্তি পাকস্থলীর বহু ‘বীভৎস ছবি’ প্রকাশ হয়েছে। 

মুম্বাইয়ের উপকূল প্লাস্টিক বর্জ্যে ঢেকে আছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সমুদ্রে ইতোমধ্যেই ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশে গেছে এবং ২০৫০ সালের ভেতর প্রায় ৯৯ ভাগ সামুদ্রিক জলজ জীবই এই প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত হবে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে সামুদ্রিক পাখিদের ‘প্লাস্টিকোসিস’ রোগ হয় এবং যা তাদের দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় (সূত্র : জার্নাল অব হেজারডাস মেটেরিয়ালস, ২০২৩)। 

জনস্বাস্থ্যের ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব
প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পরিবেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদি দূষণ ও ক্ষতি তৈরি করে (সূত্র : পাস্টিক পলিউশন কোয়ালিশন)। প্লাস্টিকবিরোধী সচেতনতা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘টিআর ফান্ডের’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উন্নয়নশীল দেশে প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ নানা রোগে ভুগে মারা যায়। প্রতি সেকেন্ডে উন্নয়নশীল দেশে দ্বিতল ট্রাকের সমপরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো বা স্তূপ করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য এবং দূষণ ডায়রিয়ার প্রকোপ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। 

প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস মাছ। পানি থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করে মাছের ভেতর। মাছ থেকে মানুষের ভেতর অনায়াসে প্রবেশ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ২০২২ সালে প্রকাশিত তিনটি গবেষণায় মানুষের গর্ভফুল, মায়ের দুধ কিংবা রক্তেও মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ইতালির পলিটেকনিকা দেল মারচে বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণায় সদ্য প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ এবং গর্ভফুলে মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করেন। ‘ডাচ ন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমনসিসের’ গবেষণায় মানুষের রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত হয়। 

ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা, থাইরয়েড, হৃদরোগ, প্রজনন সমস্যা, ব্যথা, বাত এবং নানাবিধ স্বাস্থ্যসংকট বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণের কারণে। ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত সামগ্রীর ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বাস্থ্যসংকট তৈরি করে। 

বায়ুদূষণ বাড়ায় প্লাস্টিক
কঠিন প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর মাধ্যমে বায়ুদূষণ বাড়ে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গমন হওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এমনকি এর মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। 

জনরুচি ও জনসংস্কৃতির ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব
বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১.২ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল ব্যবহৃত হয়। ৯১ শতাংশ প্লাস্টিকই আর পুনর্ব্যবহৃত হয় না। একজন মার্কিন নাগরিক মাসে ১৩টি পানির বোতল ব্যবহার করে এবং বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ৫০ বিলিয়ন পানির বোতল ক্রয় করে। বিশ্বে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপন্ন হয়। প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রেই অর্ধ বিলিয়ন প্লাস্টিক স্ট্র পানীয় পানে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বে বছরে ৫০০ বিলিয়ন প্লাস্টিক কাপ ব্যবহৃত হয় (সূত্র: ww.wearthday.org)। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ১০০ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়, যা তৈরিতে ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল লাগে (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড, ২০১৯)। প্রতিজন মার্কিন নাগরিক বছরে ৩৬৫টি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে এবং একজন ডেনমার্কের নাগরিক বছরে চারটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে (সূত্র: এলেনম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশন, ২০১৭)। 

এক মাইল গাড়ি চালাতে যে পরিমাণ জ্বালানি গ্যাসের প্রয়োজন হয় তা দিয়ে ১৪টি প্লাস্টিক ব্যাগ বানানো যায় (সূত্র : ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট, ২০২১)। দেখা গেছে, আজ বিশ্বের অধিকাংশ শহরের মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যা তাদের ক্রমান্বয়ে নিরাপদ প্রাকৃতিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের প্লেট, কাপ, স্ট্র, কটনবাড কিংবা পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়।

কারা দায়ী? করপোরেট বাণিজ্য ও নয়াউদারবাদী ভোগবাদ
ডাও কেমিক্যাল, লায়নডেল বেসেল, এক্স মবিল, এসএবিআইসি, বিএএসএফ, সিবুর, স্যিন-এস্টু কেমিক্যাল, ইন্দরামা ভেনচারস, সিনোপ্যাক, ব্রাসক্যাম বিশ্বের শীর্ষ প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কোম্পানি। প্লাস্টিকের বিরোধী আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক’ করপোরেট প্লাস্টিক দূষণ বিষয়ক তাদের তৃতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর। 

‘Branded Vol III: Demanding Corporate Accountability for Public Pollution’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বড় সব খাদ্য-পানীয়-প্রসাধন কোম্পানির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। ৫৫টি দেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী তিন লাখ ৪৬ হাজার ৪৯৪টি প্লাস্টিক নমুনা সংগ্রহ করেন। দেখা গেছে, এগুলো প্রায় সবই কোনো না কোনো কোম্পানির পণ্যের বোতল, মোড়ক ও ধারক। দেখা গেছে, কোকা-কোলা, পেপসিকো ও নেসলের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। পরপর তিনবারের মতো এরাই বিশ্বের শীর্ষ প্লাস্টিক দূষণকারী কোম্পানি। প্রতিবেদনে চিহ্নিত শীর্ষ ১০-এর অন্য প্লাস্টিক দূষণকারী কোম্পানিগুলো হলো- ইউনিলিভার, মনডেলেজ ইন্টারন্যাশনাল, মারস, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, ফিলিপ মরিস, কোলগেট-পালমোলিভ এবং পারফেট্টি। এইসব করপোরেট কোম্পানির মাধ্যমে মূলত টিকে আছে নয়াউদারবাদী ভোগবাদ। আর এই ভোগবাদের প্রলোভনই পৃথিবীতে প্লাস্টিককে টিকিয়ে রেখেছে বিশ্বায়িত জীবনযাত্রার ভেতর দিয়ে। 

আইন, নীতি ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া
২০১৪ সালে প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে শীর্ষ ১০ জরুরি পরিবেশগত সমস্যার ভেতর সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণকে তালিকাভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে দ্বিতীয় পরিবেশ সম্মেলনে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণকে পরিবেশ গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এর বহু আগেই পলিথিন নিষিদ্ধ করে। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারা অনুযায়ী, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং একই সালের ১ মার্চ বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। 

পলিথিন নিষিদ্ধকরণ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘যে কোনো প্রকার পলিথিন ব্যাগ অর্থাৎ পলিথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা উহার কোনো যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙা বা যে কোনো ধারক যাহা কোনো সামগ্রী ক্রয়বিক্রয় বা কোনো কিছু রাখার কাজে বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায় উহাদের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার দেশে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হইল।’ প্রজ্ঞাপনে বিস্কুট, চানাচুরসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সিমেন্ট, সারসহ ১৪টি পণ্যের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। 

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০০২)-এর ১৫(১) অনুচ্ছেদের ৪(ক) ধারায় পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের জন্য অপরাধীদের সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান আছে। আইন অনুযায়ী ১০০ মাইক্রোনের কম পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। 

বাংলাদেশের পাশাপাশি আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারতের মুম্বাই ও হিমাচল প্রদেশ, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকো ও ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য, কানাডা, ইরিত্রিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডায় পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

খাবার পানি, ওষুধসহ খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বাজার থেকে প্রত্যাহার ও ধ্বংসের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট ২০১৪ সালে। একই সালের ২৩ নভেম্বর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নিষিদ্ধ পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধে করণীয় নির্ধারণে জাতীয় সংসদে একটি সাবকমিটি গঠিত হয়েছিল। সাবকমিটি বাজার পরিদর্শন ও কয়েক দফা বৈঠক শেষে পলিথিন নিষিদ্ধকরণে করণীয় সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন মূল কমিটির কাছে জমা দেয়। ২০১৫ সালের ৭ মে মূল কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি অনুমোদন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়।

২০১৯ সালে বেলাসহ ১১টি পরিবেশ সংগঠন একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধে রিট করে। পরে দেশের উপকূল অঞ্চলে, দেশের সর্বত্র হোটেল-মোটেল ও রেস্তরাঁয় পানিবহনকারী প্লাস্টিকের বোতলসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়। ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি প্লাস্টিক বন্ধের ব্যাপারে কী কী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা বিবাদীদের জানাতে বলা হয়। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের ভেতর পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের নিরাপদ বিকল্প সামগ্রীর ব্যবহার বাড়াতে কেন একটি কর্মপরিকল্পনা করা হবে না তাও রুলে জানতে চাওয়া হয়। 

কামরাঙ্গীরচরে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়।

প্লাস্টিক দূষণ রোধে ১০ বছর মেয়াদি এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৯২টি মামলা দায়ের, ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায়, ১ হাজার ৭৬০ টন পলিথিন জব্দ এবং ১৬৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে। সুন্দরবনে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ভেতরে দেশকে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকমুক্ত করতে লক্ষ্য অর্জনে প্রথম ধাপে সকল সরকারি দপ্তরে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানা যায়। সরকারি দপ্তরগুলোতে প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতলে পানি রাখার জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এমনকি সরকারি আমন্ত্রণপত্র, নিমন্ত্রণপত্র, ভিজিটিং কার্ড এবং ফাইল ফোল্ডারে প্লাস্টিক ব্যবহার ও লেমিনেটিং ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধে প্রাথমিকভাবে দেশের ১২টি জেলার ৪০টি উপজেলাকে বেছে নিয়েছে সরকার।

আমরা কী করতে পারি
প্লাস্টিক টিকে থাকার অন্যতম কারণ উৎপাদন, ভোক্তার সংস্কৃতি এবং বাজার। এখানকার পণ্য, ক্রয়-বিক্রয়, বিজ্ঞাপন, ক্রেতা-ভোক্তার রুচি ও চাহিদা, সহজলভ্যতা, লাগাতার ভোগবাদী মনস্তত্ত্ব সবকিছুই মানুষকে প্লাস্টিকমুখী করে তোলে। অনেকেই বলবেন এখন আগের সেই দিন নেই, পদ্মপাতায় গুড় বা কাচকি মাছ কেউ বেঁধে দেবে না। তাতে যে ক্রেতার সম্মানহানি হবে। কাচকি মাছের গন্ধঅলা পানি বা গুড়ের রস পড়ার ভয়। আজুগি পাতা, শাল পাতা, কলাপাতা, শটি পাতা নিয়ে এখন দোকানিরা বসে না। বাজার করতে কেউ বাঁশের খলই, ঝুড়ি, পাটের থলে, নকশা করা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয় না। কিন্তু ‘সোনালি আঁশের দেশ’ আজ প্লাস্টিক-দূষণে আক্রান্ত হবে কেন? 

প্লাস্টিক-দূষণ রোধে আমাদের স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও জনতৎপরতা তৈরি করতে হবে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে এই কাজটা আমরা শুরু করতে পারি। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও দেশজ উপকরণসমূহের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিপণন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। বাঁশ-বেত, পাট, কাঠ, কাচ, কাগজ, কাপড় ও মৃৎশিল্পনির্ভর জীবিকাকে উৎসাহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। 

একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে দেশজ উপাদানে তৈরি উপকরণসমূহের ব্যবহার বাড়লে দেশের পাটশিল্প, কাচশিল্প, কাঠশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, শিশু খেলনা শিল্প, হাতে তৈরি কাগজ শিল্পসহ বহু সৃজনশীল প্রাকৃতিক কুটিরশিল্প একটা নতুন চেহারা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। প্লাস্টিকের ভয়াবহ ঝুঁকি থেকেই কেবল এই উদ্যোগ আমাদের সুরক্ষা করবে না, বরং পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি জাতীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে। নিঃসন্দেহে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে দেশজ প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভর কুটিরশিল্পকে বিকশিত করার ভেতর দিয়ে দেশের সবুজ অর্থনীতি বিকশিত হতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে মাতৃদুনিয়ার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর এ কাজে দেশের শিশু, তরুণ, প্রৌঢ়, প্রবীণ সকল বয়স-পেশা-লিঙ্গ-জাতি ও ভূগোলের সকল নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও তৎপরতা জরুরি। 

লেখক : প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //